বালাইনাশকের নিরাপদ ব্যবহারে করণীয়
এ জেড এম ছাব্বির ইব্নে জাহান
ফসলের ক্ষতিকর পোকামাকড়, রোগবালাই, আগাছা ইত্যাদিকে এককথায় বলে বালাই। এরা ফসলের ক্ষতি করে উৎপাদন হ্রাস করে, চাষাবাদের খরচ বাড়িয়ে লাভ কমিয়ে দেয়। বালাই দমন করতে যেসব রাসায়নিক, অরাসায়নিক, জীব ও উদ্ভিদ বস্তু ব্যবহার করা হয় তাদেরকে বলা হয় বালাইনাশক (চবংঃরংরফব)। সাধারণ রাসায়নিক বালাইনাশকসমূহ ‘বিষ’ নামে পরিচিত। বালাইনাশকসমূহ ফসলের বালাই ধ্বংস করে, এদেরকে ফসল থেকে দূরে রেখে, আকর্ষণ করে ফাঁদে ফেলে জন্ম নিয়ন্ত্রণ করে নানাভাবে ফসলকে ক্ষতিকর বালাই থেকে রক্ষা করে।
বালাইনাশক বালাই এর জন্য ক্ষতিকর। তবে মাত্রা, প্রকৃতি, পরিবেশ ইত্যাদির কারণে এরা মানুষ ও পরিবেশের জন্যও অনিরাপদ হয়ে উঠতে পারে। সুতরাং একটি বালাইনাশক সাধারণভাবে নিরাপদ হলেও অবস্থাভেদে তা আর নিরাপদ নাও থাকতে পারে। বালাইনাশকের প্রকারভেদ অনুসারেও এটা নিরাপদ কতটুকু তা নির্ভর করে।
বালাইনাশকের ক্ষতিকর প্রভাব : বর্তমানে ফসল উৎপাদনে বালাইনাশক অপরিহার্য উপকরণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ফলে এর যথেচ্ছ ব্যবহারের ফলে এদের ক্ষতিকর প্রভাবে মানব স্বাস্থ্য ও পরিবেশ মারাত্মক ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে।
মানবদেহে বালাইনাশকের ক্ষতিকর প্রভাব : মানবদেহে বালাইনাশকের ক্ষতিকর প্রভাব দ্বিমুখী। প্রথমত তাৎক্ষণিক প্রভাব (অপঁঃব বভভবপঃ) এবং দ্বিতীয়ত দীর্ঘমেয়াদি (ঈযৎড়হরপ বভভবপঃ) ।
তাৎক্ষণিক প্রভাবের ফলে নাক ও চোখ এবং ত্বকে, গলায় চুলকানি, বমিবমি ভাব, ঝিমুনি, ঝাপসা দেখা, খিচুনি, ডায়রিয়া ইত্যাদি হয়। কখনো শ্বাসকষ্ট জাতীয় উপসর্গ দেখা দিতে পারে। হাঁপানি রোগীদের ক্ষেত্রে প্রতিক্রিয়া আরো বিরূপ হতে পারে। সাধারণত রাসায়নিক কীটনাশক যেমন:- অর্গানোফসফরাস, অর্গানোকার্বামেট ইত্যাদি থেকে এসব হতে পারে।
দীর্ঘমেয়াদি প্রভাবে ক্যানসার, টিউমার, জন্মগত ত্রুটি, বন্ধাত্ব, অন্যান্য প্রজননগত সমস্যা, লিভারের ক্ষতি, প্রসটেটের সমস্যা, কিডনির ক্ষতি, ফুসফুসের ক্ষতি এবং দেহের অন্যান্য অঙ্গের ক্ষতি ইত্যাদি। দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতিগুলো বালাইনাশক ব্যবহারের কয়েক সপ্তাহ বা কয়েক মাস এমন কি কয়েক বছরের মধ্যে দেখা দিতে নাও পারে। তাই এগুলো যে বালাইনাশক ব্যবহার থেকে হয়েছে তা সহজেই বুঝতে পারা যায় না। পরিণত বয়স্কদের তুলনায় শিশু ও তরুণদের উপর এ ক্ষতির প্রভাব তুলানামূলক বেশি।
পরিবেশের উপর বালাইনাশকের ক্ষতিকর প্রভাব
বালাইনাশকের অপরিকল্পিত ব্যবহারের ফলে মাটি, বায়ু, পানি প্রভৃতি দূষণ হতে পারে, বিশেষ করে পুকুর, জলাধার, খাল-বিল, নদী-নালা এবং এতে থাকা মাছ ও জলজপ্রাণী, ফাইটোপ্লাংটন, জুপ্লাংটন, জলজউদ্ভিদ, ব্যাঙ ইত্যাদি আক্রান্ত হতে পারে এবং বড় ধরনের বিপর্যয় সৃষ্টি করতে পারে। এ ছাড়া এসব পানি ব্যবহারকারী লোকজন ও গবাদিপশুও বালাইনাশকের বিষক্রিয়ায় আক্রান্ত হতে পারে। ভূপরিস্থিত পানির সাথে সাথে মাটির নিচে অবস্থিত পানিও দূষিত হতে পারে। ফলে পানীয় জল বিষাক্ত হয়ে বিপর্যয় সৃষ্টি করতে পারে। বালাইনাশক পরাগায়নকারী প্রাণী যেমন- মৌমাছি ও অন্যান্য পতঙ্গদের উপরও বিষাক্ত প্রভাব রাখতে পারে। পাখি ও পাখিজাতীয় প্রাণীও বালাইনাশকের ক্ষতির কারণে সমূহ বিপদে পড়তে পারে। যেমন- শকুনের সংখ্যা হ্রাসে গবাদিপশুকে দেয়া এক জাতীয় ওষুধের ব্যবহারকে পরিবেশ বিজ্ঞানীগণ দায়ী করে থাকেন। বালাইনাশকের ক্ষতিকর প্রভাবে মাটিতে থাকা কেঁচো, শতপদী ও অন্যান্য পোকামাকড় ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে ফলে মাটির ভৌতিক ও রাসায়নিক গুণাবলি নষ্ট হয়ে ভূমির উর্বরতার ক্ষতি হতে পারে।
বালাইনাশকের ক্ষতিকর প্রভাবে স্থায়িত্ব
বালাইনাশকের ক্ষতিকর প্রভাব কয়েক ঘণ্টা থেকে অনেক বছর পর্যন্ত হতে পারে। বালাইনাশকের ক্ষতির স্থায়িত্ব নির্ভর করে বালাইনাশকের প্রকৃতি, মাত্রা, ব্যবহার পদ্ধতি, পরিবেশের তাপমাত্রা, আর্দ্রতা, সূর্যালোক প্রভৃতি ফ্যাক্টরের উপর। সাধারণত কৃষি কাজে ব্যবহৃত অনুমোদিত বালাইনাশকের “নিরাপদ কাল” অর্থাৎ ফসলে বালাইনাশক প্রয়োগের কত দিন পর ফসল উঠালে তার মধ্যে ক্ষতিকর প্রভাব থাকবে না বা ফসলটি নিরাপদভাবে ব্যবহার করা যাবে তা সাধারণত একদিন থেকে পঁচিশ ত্রিশ দিন পর্যন্ত হতে দেখা যায়। তবে কোন কোন বায়োপ্যাস্টিসাইডের ক্ষেত্রে এমন কোন ধিরঃরহম ঢ়বৎরড়ফ বা নিরাপদ কাল নাও থাকতে পারে।
বালাইনাশকের নিরাপদ ও কার্যকর ব্যবহার পদ্ধতি
নিচে বালাইনাশক নিরাপদে ও কার্যকরভাবে ব্যবহারের জন্য অনুসরণীয় পদ্ধতিগুলো সংক্ষেপে তুলে ধরা হলো।
া রাসায়নিক বালাইনাশক প্রেসক্রিপশন/ব্যবস্থাপত্র মেনে লেবেলের নির্দেশনা অনুযায়ী ব্যবহার করা ।
া আইপিএম পদ্ধতি মেনে ফসল চাষ ।
া উত্তম কৃষি পরিচর্যা তথা এঅচ অনুস্মরণ করে বাণিজ্যিকভাবে ফসল চাষ। এক্ষেত্রে বালাইনাশকে ব্যবহারের রেকর্ড সংরক্ষণ করতে হবে যেন ট্রেন্সিবিলিটি/শনাক্তকরণ সহজ হয়।
া সম্ভব ক্ষেত্রে বায়ো পেস্টিসাইড, বায়োলজিক্যাল এজেন্ট, বোটানিক্যাল এসব ব্যবহার।
া বালাইনাশক শিশুদের নাগালের বাইরে নিরাপদ স্থানে রাখা।
া বালাইনাশক ছিটানোর সময় প্রয়োজনীয় সতর্কতা অবলম্বন ও পিপিই ব্যবহার।
া বালাইনাশক বিক্রির ক্ষেত্রে লাইসেন্স উল্লেখিত অনুসরনীয় নীতি মেনে চলা।
া বাতিল, মেয়াদ উত্তীর্ণ, খোলা, নকল, ভেজাল, নিম্নমানের বালাইনাশক ব্যবহার না করা।
া লাইসেন্সধারী ডিলার/বিক্রেতার দোকান থেকে ক্যাশ মেমোর মাধ্যমে বালাইনাশক জয় করা।
া বালাইনাশক জমিতে ছিটানোর সময় পানিতে দ্রবণ তৈরি কালে কোনভাবে না শুঁকা ও প্রয়োজনীয় সতর্কতা মূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা।
া প্রখর রোদে, শরীরে কাটা-ছেঁড়া আঘাত নিয়ে, অসুস্থ শরীরে স্প্রে না করা। স্প্রে কালে ধূমপান বা কোন কিছু না খাওয়া।
া বাতাসের বিপরীতে স্প্রে না করা।
া ফাটা, ছিদ্র যুক্ত ও ত্রুটিপূর্ণ স্প্রে যন্ত্র ব্যবহার না করা।
া স্প্রে শেষে বেঁচে যাওয়া দ্রবন যেখানে সেখানে বা পুকুর, নদী, খালে বিলে না ফেলা, যন্ত্রপাতি, পোশাক পরিচ্ছেদ, সুতা ইত্যাদি পুকুর, নদী ইত্যাদি স্থানে না ধোয়া।
া বিজ্ঞান সম্মতভাবে কোন ফসলে বালাই দমন কার্যক্রম শুরুর আগে বালাই জরিপ বা সার্ভিলেন্স (অতন্দ্র জরিপ) এবং পূর্বাভাস বা আগাম সতর্কীকরণ সংক্রান্ত কার্যক্রম নেয়া উচিত। এর ফলে সহজে ও নিরাপদে বালাই নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হয়;
বালাই ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে নি¤েœাক্ত পদক্ষেপসমূহ
া আধুনিক জাত বা রোগ প্রতিরোধি জাত ব্যবহার;
া আধুনিক পদ্ধতিতে চাষাবাদ;
া যান্ত্রিকভাবে বালাই দমন;
া জৈবিক দমন;
া সর্বশেষ ব্যবস্থা হিসেবে সঠিক ঔষধ, সঠিক মাত্রা, সঠিক সময়ে, সঠিক পদ্ধতিতে ব্যবহার করা;
া বিষাক্ততার মাত্রা অনুসারে বালাইনাশকের লেবেলে উজ্জ্বল লাল (অতীব বিষাক্ত), উজ্বল হলুদ (মধ্যম বিষাক্ত) এবং উজ্জ্বল সবুজ (মৃদু বিষাক্ত) ধরনের সংকেত দেয়া থাকে। ফসলে ব্যবহারের সময় সেসব সংকেত মেনে চলা উচিত।
বালাইনাশকের নিরাপদ সংরক্ষণ :
বালাইনাশক সাবধানতার সাথে নির্দেশনা মেনে সংরক্ষণ করা উচিত। প্রয়োজনমতো আর্দ্রতা, তাপমাত্রা বজায় রেখে এদের নিরাপদে রাখা দরকার। এখানে নিরাপদ সংরক্ষণের কিছু বিষয় অল্প কথায় তুলে ধরা হলো।
া বালাইনাশক সাধারণের নাগালের বাইরে রাখা দরকার।
া বালাইনাশক কোনোক্রমে পশু খাদ্য হাঁস মুরগি খাবার, মানুষের খাবার ইত্যাদির সাথে এক জায়গায় বা আলমারি, মিচচেফ, তাক, শিকা, গোলা, ড্রাম, বস্তা ইত্যাদিতে রাখা উচিত নয়।
া ব্যবহৃত বালাইনাশকের প্যাকেট, বোতল, ড্রাম বা পাত্র গর্ত করে নিরাপদ মাটির নিচে পুঁতে রাখতে হবে। কোনক্রমেই বালাইনাশকের প্যাকেট, শিশিতে, বোতলে, ড্রামে খাবার জিনিস, ঔষধপত্র, খাবার তেল ইত্যাদি রাখা যাবে না।
া দোকানে বালাইনাশকের আলমারি তালা বদ্ধ অবস্থায় রাখার ব্যবস্থা থাকতে হবে।
া যে স্থানে বালাইনাশক সংরক্ষণ করা হবে সে স্থানে “বিপজ্জনক চিহ্ন” বা লাল কালিতে বিপদ জনক/বিষ কথাগুলো লিখে রাখা উচিত।
বালাইনাশক বিষক্রিয়া বা দুর্ঘটনার ক্ষেত্রে প্রাথমিক করণীয় :
বালাইনাশকের পাত্রের গায়ে লেবেলটি পাঠ করে ব্যবস্থা নিতে হবে। রোগীকে খোলামেলা স্থানে রাখতে হবে, কাপড় চোপড় যথাসম্ভব খুলে দিতে হবে। গা, হাত, পা, মুখ, চোখ এমন কি যেসব স্থানে শরীরে বালাইনাশক লেগেছে যেসব স্থান পরিষ্কার পানি ও সাবান দ্বারা ভালোভাবে ধুয়ে দিতে হবে বা গোসল দিতে হবে। সম্ভব হলে রোগীকে বমি করাতে হবে। তবে অজ্ঞান অবস্থায় বমি না করিয়ে দ্রুত নিকটস্থ ডাক্তারখানায় নিতে হবে। অর্গানো ফসফরাস, অর্গানোকার্বামেট ইত্যাদি জাতীয় বালাইনাশকের ক্ষেত্রে ডাক্তারের পরামর্শে এট্রপিন জাতীয় প্রতিষেধক ঔষধ দেয়া যেতে পারে।
বালাইনাশকের নিরাপদ ব্যবহারের ক্ষেত্রে উৎপাদনকারী, বিক্রেতা, ব্যবহারকারী এবং জনসাধারণ সকলকেই সচেতন হতে হবে। তবেই বালাইনাশকের সুফল ভোগ করে এর ক্ষতি এড়িয়ে লাভজনক ফসল উৎপাদন করা সম্ভব হবে।
লেখক : পরিচালক (অব:), উদ্ভিদ সংরক্ষণ উইং, মোবাইল : ০১৭৯৩১২৩৭০৩